পেন্সিলে লিখা বাবার ডায়েরি (ধারাবাহিক উপন্যাসঃ পর্ব-১৮)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ০৫ জানুয়ারি, ২০১৫, ০৯:৪৬:৫২ সকাল
মিথিলা বাবু!
দাদী গুরুতর অসুস্থ হয়ে গেলেন। আব্বার অফিসে ফোন এলো। আব্বা খবরটা পেয়েই বাসায় চলে এলেন। আম্মা খবর শুনে কাঁদতে শুরু করলেন। বিকালে আমরা সবাই রওনা দিলাম। এত বছর পর বাড়ি যাচ্ছি, মন খারাপ, দুশ্চিন্তা আর অস্বস্তি সব মিলে মনটা কেমন হয়ে রইল। প্রায় সব কিছুই নতুন। দুই একটা পুরনো গাছ বা দোকান এখনো আছে দেখে খুব অবাক লাগল। পুরনো দিনকে মানুষ একেবারে মুছে দিতে পারে না আসলে!
আমাদের পৌঁছতে রাত হল। লঞ্চঘাটে লোক অপেক্ষায় ছিল। নতুন নতুন বাজার, ঘরবাড়ি, দোকানপাট পার হয়ে দাদার বাড়ির সামনে এসে অবাক হলাম। শহরের বাড়ির মত বিশাল গেট! গেট পার হয়ে ভিতরে পা রেখে স্তব্ধ হলাম। সেই চিরচেনা উঠানটা নেই! ঘরগুলি পাকা হয়ে সামনে চলে এসেছে! গেটের আলোয় পিছন থেকে পুরনো বাড়ির মাথার চাঁদতারা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে! ভিটা বাউন্ডারি ওয়াল দিয়ে গ্রাম থেকে আলাদা করে ফেলা হয়েছে! সারা বাড়ি ইলেক্ট্রিসিটি আলোয় ভরা, কিন্তু সুনসান! আমার এত বছরের স্বপ্নের শৈশব হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। মন আরো খারাপ হয়ে গেল। মা বাবাকে দেখে মনে হল কোন পরিবর্তনই তাদের চোখে পড়ল না। আমাদেরকে পেয়ে কিন্তু বেশ ভীড় হয়ে গেল।
ছোটদের মধ্যে অনেককেই চিনলাম না। চাচীরা আমাকে দেখে অনেক অবাক হলেন। বড় চাচার চুল সব সাদা হয়ে গেছে! চাচী এতটা মোটা হয়েছেন যে তার চেহারাই বদলে গেছে!
মুখহাত ধুয়ে দাদীর ঘরে গিয়ে প্রাণে শান্তি পেলাম। সেই পুরোনো ঘর। পুরনো খাট। খাটে বালিশের পাশে ঢাকনিওয়ালা পানের বাটা। পুরনো আলমিরা। ছোট্ট জানালায় এক টুকরা সুতার পর্দা। জানালার উপরে কাঠের তাকের উপর সবুজ কাপড়ে মোড়ানো পবিত্র কোরআন শরীফ। শুধু নামাযের চৌকিটা নতুন। এখনো দাদী আর দাদাভাইয়ের বিয়ের বাঁধানো ফটো ঝুলছে।
খাটে শোয়া দাদীকে খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। আব্বা আর আম্মা দু'জন খাটের পাশে দাঁড়াতেই দাদী মুখের উপর থেকে চাদর সরালেন। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলাম, অভিমানী দাদী মুখ ফিরিয়ে নিলেন। বাবা, মা মাথা নিচু করলেন। কিন্তু সরে এলেন না।
পরদিন সকাল হতে হতে দাদী একদমই সুস্থ হয়ে গেলেন। একে ওকে এটা ওটা আদেশ নির্দেশ দিতে লাগলেন। কেউ পিঠা বানাতে গেল। কেউ পায়েস করতে গেল। রোদ ঝলমলে দিনটা দেখে বিশ্বাস হলো না আমরা একটা আস্ত পরিবার মৃত্যুপথযাত্রী কাউকে শেষবার দেখার জন্য এসেছি! রীতিমত উৎসব শুরু হলো।
দুপুরে খাওয়ার পর গ্রামে ঘুরতে বের হলাম। আমাদের সেইসব রাস্তা, খেলার মাঠ, স্কুল - সবই এক এক ভাবে বদলে গেছে। আমি সব দেখছিলাম কোন আগন্তুকের মত। ছেলেবেলার বন্ধুদের দুই একজনকে পেয়ে গেলাম। তারা বিপুল উৎসাহে ঘরে নেবার জন্য টানাটানি শুরু করল। একজন প্রস্তাব করল বাজারে গিয়ে শৈশবের বন্ধু ইসুর দোকানে চা খাওয়ার। সেই সন্ধ্যাটা খুব ভালো কাটল।
রাতে বড় চাচার ঘরে আব্বারা সব ভাই একসাথে খেলেন। খেতে বসে দাদী সম্পত্তি বিষয়ে কথা তুললেন। সেদিন আলোচনার অর্ধেকে আমার খাওয়া শেষে উঠে যাচ্ছিলাম। আব্বা ডেকে বসালেন। বড়দের আলাপে প্রথম আব্বা আমাকে থাকতে বললেন। কেমন লাগছিল!
এক সময় প্রতিদিন আব্বার সাথে মাপ দিতাম আর দেখতাম কত বড় হয়েছি। ওইদিন আমার মনে হলো আমি বাবার সমান হয়েছি। কিন্তু কেন যেন কষ্ট হচ্ছিল।
পরদিন চেয়ারম্যান আর মেম্বারের সামনে দাদার সম্পত্তি ভাগ হলো। আব্বাকে কে একজন জিজ্ঞেস করল,' তুমি শহরে বড় বিল্ডিং করে থাকো, বাড়ী আসোনা, তোমার সম্পত্তি দেখাশোনা কে করবে?' আব্বাকে সারা সময় আমার অসুস্থ লাগছিল। তিনি মৃদু স্বরে বললেন,'কারো দেখতে হবে না'। অন্য একজন বলল,' সম্পত্তি ফেলে রাখবেন ক্যান, কাউরে বেচে দ্যান! ' আব্বা হঠাৎ প্রচন্ড স্বরে বললেন, 'না!' সবাই চুপ হয়ে গেল। একজন কেউ আব্বাকে সান্ত্বনা দিলেন। আমি সরে এলাম। পরে শহরে এসে জেনেছিলাম, চাচারা আমাদের ভাগ কিনার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন!
মনটা অস্থির হয়ে গিয়েছিল। আগের দিনের মত লাগছিল না কিছু। পরদিন খুব ভোরে শহরে ফিরলাম। ঠিক যেন একই মানুষ ফিরলাম না। খানিকটা ভিন্ন। বুঝতে পারছিলাম না, কোথায় বদলে গেছে কিছু।
টেস্টে রেজাল্ট মাঝারি ধরণের হলো। আমি সন্তুষ্ট ছিলাম। লোকজন অতিরিক্ত আশা করবে না। মনের উপর ততটা চাপ রইল না। কিন্তু পরীক্ষার জন্য আব্বা আম্মার আগের সেই আয়োজন না থাকাতে নিজেকে কেমন বাইরের মানুষ মনে হতে লাগল। অজান্তেই লাভলি আমার ঘরের মানুষ হয়ে গেল। তার সাথে আমার চিঠির লেনদেন চলতে থাকল। আর এই চিঠিই সর্বনাশ করল একদিন। লাভলির পরিবারের কুখ্যাতিটা অনেকদিন পর আবার নতুন করে অনুভব করলাম।
কিভাবে যেন লাভলিকে লেখা একটা চিঠি ওর ঘরের কারো হাতে পড়েছিল। প্রায় এক সপ্তাহ কোন চিঠি এলো না। ওর সব বান্ধবীর সাথেও ওকে দেখা করতে দেয়া হচ্ছিল না। ঘটনা যখন আমার কানে এলো তখন অনেক কিছুই হয়ে গেছে। ওর গায়ে হাত তোলা হয়েছে, ও ঘুমের ওষুধ খেয়েছে, হাসপাতালে নিয়ে ওয়াশ করা হয়েছে। আরিফুলের কাছ থেকে ওসব শুনে ছটফট করতে থাকলাম। কিন্তু আরিফুল আমাকে কোন উপায় বলতে পারল না। এরপর মিনার মা মিনার বাইরে বের হওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। আরিফুল ওর সাথেও কোন যোগাযোগ করতে পারল না। লাভলির ঘরের লোকেরা কেন আব্বা আম্মার কাছে নালিশ করলেন না তা আমি ভেবে পেলাম না। খুব অদ্ভুত লাগল।
আরিফুল কী করে যেন লাভলিদের বাজার করার ছেলেটাকে হাত করল। ওর কাছ থেকে লাভলির অবস্থা জেনে এলো। ওকে রাস্তার দিকের রুম থেকে সরিয়ে ওর এক চাচীর রুমে দেয়া হয়েছে। মানে সেই চাচী তখন ওর রুমে। আরিফুল এই খবর পেয়ে খুশি হয়ে গেল। ওই চাচীর নাম ডলি। ডলি চাচীর সাথে তার পরিচয় আছে। সে ওই ছেলেটাকে দিয়ে ডলি চাচীর সাথে নিজের নাম করে আমার দেখা করার ব্যবস্থা করল। দেখা হল। আরিফুল সব বলল উনাকে। আমি স্বীকার করলাম। উনি হাসিমুখে আশ্বাস দিলেন,'পরীক্ষাটা শেষ হোক, চুপচাপ পরীক্ষা দাও, আমি দেখি কী করা যায়। কিন্তু আমি যে জানি তা যেন কেউ যেন না জানে'। কথা দিলাম। কথা রাখলাম। লাভলির সাথে স্টুডিওতে গিয়ে একটা ছবি তুলেছিলাম। লুকিয়ে রেখেছিলাম। লুকিয়ে দেখতাম। খুব ইচ্ছে হতো একবার দেখি।
এডমিট কার্ড নেয়ার দিন ও ডলি চাচীর সাথে এলো। দূর থেকে দেখলাম। কথা হলো না। ওকে রোগা দেখাচ্ছিল। মন আরো খারাপ হলো। কিন্তু পড়ায় অবহেলা করলাম না। রেজাল্টের উপর অনেক কিছু নির্ভর করে। এমনকি, লাভলিকে পাওয়া ও।
আল্লাহর দয়া, ডলি চাচী আমাদের নিরাপদ অভিভাবক, বন্ধু, পোস্ট বক্স হলেন। চিঠিগুলি আসা যাওয়ার পথ পেলো। ভবিষ্যত অন্তত অন্ধকার লাগছিল না আর। কষ্ট অনেক কমলো।
ঘোষনা করা রুটিন অনুযায়ী এইচ এস সি পরীক্ষা শুরু হলো। জগৎ সংসার ভুলে গেলাম। লাভলি হলো দূরের আকাশের তারা।
(ক্রমশঃ)
বিষয়: সাহিত্য
১১৮৩ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
জাজাকাল্লাহু খাইর।
জীবন কে খুব কাছ থেকে দেখেছেন- তা বুঝা যায়! এতো গভীর ভাবে আয়ত্বে এনেছেন ভাবতে অবাক লাগে!
সুম্দর নান্দনিক উপস্হাপনা মুগ্ধতার পরশই বুলিয়ে শুধু!
অনেক ধন্যবাদ ও জাযাকাল্লাহু খাইর!!!
অনেক অনেক ধন্যবাদ।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
সুন্দর অনুভূতি রেখে গেলেন, অনেক ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন